পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৭

নৈঃস্বর্গীক ব-দ্বীপে


   
এক.

সময়টা ১৩৪৫ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহের কোন একদিন। আকাশে উজ্জ্বল রোদ, সাগরের ঢেউ তোলা জলের উপর রোদের ঝিলিক, ঠিক তেমনি ঝিলিক ক্লান্ত অনেকগুলো চোখে। চোখগুলো যাদের তারা সকলে একটি বড় সড় পাল তোলা জাহাজের আরোহী। বহুদূর মালদ্বীপ নামক এক ক্ষুদ্র্র দ্বীপের মহল বন্দও হতে যাত্রা করেছিল জাহাজটি প্রায় তেতাল্লিশ দিন আগে। নানা ঝড় ঝঞ্ঝা আর ভারত মহাসাগরের বিশাল জলারাশি পেরিয়ে বঙ্গপোসাগর নামের এক উপ সাগরের অশান্ত ঢেউ উৎরে এসে আজ অভিযাত্রী দলের চোখের সামনে উত্তর-পূর্বে এক সবুজ তীরের হাতছানি, দূর থেকেই দেখা গেলো দীর্ঘ তট, সাদা বালুর চাদর বহুদূর পথে বিছিয়ে রেখেছে যেন কেউ, সে বালুচরের পরেই ঘন সবুজ। অভিযাত্রী দলের চোখে ঝিলিকতো চমকাবেই। 


অভিযাত্রী দলের নেতা একজন মুসলিম। সম্মুখের এই দেশটির সম্পর্কে আগেই শুনেছে। সে জানে ইন্দো-গঙ্গা সমতলে অবস্থিত এই ব-দ্বীপ অঞ্চলে পারস্য আচারে ইসালামীক সংস্কৃতি প্রভাব ফেলেছে তুর্কী শাসকদের আগ্রাসনে আর নানান সুফী দরবশের বদৌলতে। মরোক্ক হতে শুরু তার দীর্ঘ অভিযানে এই দেশটির কথা সে শুনেছে পারস্যের খোরাসানে, শুনেছে দিল্লির সালতানাতে, শুনেছে ভারতবর্ষের আরও অনেক খানেই। সে শুনেছে এখানে ঘন জনবসতি হলে কি হবে এখানের জমিতে সোনা ফলে, এখানে বিস্তৃত সবুজ বাগান অবারিত এবং এখানে এক সবুজ সমতলের স্বর্গভূমি বিস্তৃত। সে আরও জানে তাদের মত আরবীয় পর্যটকদের জন এখানের স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া বেশ কষ্টদায়কও বটে। ঐ তো সম্মুখে সেই কাঙ্খিত ভূমি। ওখানেই তাকে যেতে হবে তাই আবহাওয়া যতই চিত্ত বিপরিত হোক। সে একটু একটু করে ক্লান্ত সব সঙ্গী, নাবিক আর ক্রীতদাস দাসীদের এগিয়ে নিতে বলে জাহাজ বন্দরের দিকে । 

অতঃপর সেই জাহাজ ভীড়ে যায় সাগর তীরে এক বড় শহরে। অভিযাত্রী দলের নেতা তার মাতৃভাষার উচ্চারণে যে শহরের নাম অন্যদের কাছে জানায় তা হলো সাদকাঁওয়া যদিও স্থানীয় বাংলা ভাষায় শহরটির নাম চাটগাঁ। তীরে অসংখ্য ছোট বড় জাহাজ দেখে তিনি মুগ্ধ হন। নেতা তার সহযোগী দের নিয়ে সেই বিশাল শহরে অবতারণ করলেন। সেখানের মানুষের আতিথ্য গ্রহণ করলেন। বেশ করে ঘুরলেন। দেখলেন এখানের গঞ্জ আর বাজার প্রচুর পরিমাণে চাল, কাপড় আর নানান শস্য ও সবজিতে ভরপুর। তিনি পৃথিবীর বহু দেশ বহু অঞ্চল ভ্রমণ করেছেন কিন্তু এই দেশটির মতো এমন সস্তা দ্রব্য আর কোথাও বিক্রি হতে দেখেননি। অন্যতম সহযোগী নাবিক আল তুজারিকে নিয়ে তিনি বাজারে বাজারে ঘুরে অনেক তথ্য সংগ্রহ করলেন আর বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে এই আজব সুন্দর দেশটির সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হতে লাগলেন। তিনি দেখলেন এখানে বাজারে যে চালের পসরা বসে সেখানে সেখানে মাত্র এক রুপার দিনার (তখনকার ভারতে আট দিরহামের সমান) এর বিনিময়ে দিল্লীর ২৫ বরতল ( এক বরতল প্রায় ১৪ সের) চাল পাওয়া যায় ( বর্তমান সময়ের মূল্যে ১১ পয়সায় মণ চাল), তথাপি সেই দামই যেন এখানের লোকের কাছে চড়া। নেতা অবাক হয় দেখেন। তিনি কাপড়ের বাজারে অদ্ভূত সুন্দর এবং অতি মাত্রায় সূক্ষ্ম ও মিহি সূতোর কাপড় দেখলেন, যাকে স্থানীয়রা মসলিন নামে চেনে। এ কাপড়ও খুব সস্তা। তিনি দেখলেন এই শহরে ক্রীতদাসী এবং ক্রীতদাসও বিক্রি হয় অনেক সস্তায়। তিনি নিজের জন্য এক অতিমাত্রায় আকর্ষনীয় শ্যাম বর্ণের ক্রীতদাসী খরিদ করলেন মাত্র একটি সোনার দিনারের ( বর্তমান সময়ের মূল্যে মাত্র ১০ টাকা) বিনিময়ে, তার নিজের দেশে এমন এক ক্রীতদাসী খরিদ করতে কমপক্ষে আট টি সোনার দিনার প্রয়োজন হতো। ক্রীতদাসীর নাম স্থানীয় ভাষায় কঙ্কাবতী। তার এক সহযোগী আল তারাঙ্কাজি মাত্র দুই স্বর্ণমুদ্রায় কিনলেন সুদর্শন এক ক্রীতদাস বালক। বালকটির স্থানীয় নাম লুলু। 

যতই সামলে আগালেন এই ব-দ্বীপের প্রতি তার মুগ্ধতা বেরেই চলেছিলো। তিনি আরও গভীরে প্রবেশ করতে চাইলেন। তিনি জানেন বাংলা নামের এই এলাকার আরও সুন্দর এবং প্রসিদ্ধ শহর গুলো হলো সুনারকাঁওয়া (সোঁনারগাঁও), সাঁতগাও, কামারু (কামরূপ), হাবাঙ্গ (হবিগঞ্জ) এবং লাকনাউটি (গৌড়)। সাথের সহযোগী আল তুজারিকে জানালেন তিনি এই নতুন এলাকার প্রসিদ্ধ শহরগুলো আরও ঘুরে দেখতে চান। আল তুজারি প্রকৃত জন্মস্থান আরবের এক মরু এলাক। এই এলাকার মত এমন সবুজ শ্যামল, সমতল আর নদীর জলের স্বচ্ছ প্রবাহ কখনই তারা দেখেনি। সেও মুগ্ধ। তার দলের নাবিকদের সে রাজি করায়। তারা এগিয়ে চলে নৌকা নিয়ে। গঙ্গা আর যমুনা উভয়ে যেখানে সাগরে মিলেছে তারা সে স্থান অতিক্রম করে মেঘনা নদী পথে গভীরে এগিয়ে চলে। অভিযাত্রী দলের নেতা শুনেছে কামারুর পাহাড় যেখানে শেষ হয়েছে ( বর্তমান সিলেট) সেখানে হযরত শাহজালাল নামে এক কামেল সুফী পুরুষ বসবাস করেন। তার সাথে দেখা করতেই হবে। জাহাজ সেদিকেই এগিয়ে চলে। 

যাত্রা পথে বাংলার নদীর দুপাশে সর্বত্র সমতল নদী বিধৌত ভূমি দেখতে পান, তিনি এবং তার সহযোগীরা অবাক তাকিয়ে থাকে বারংবার। নদীর দুপাশে সর্বত্র কেবল ধানের ক্ষেত। কর্মঠ কৃষককূলের ধান কাটা দৃশ্য, মাথায় কাটা ধানের বোঝা নিয়ে ধিম তালে খালি গায়ে কৃষকের এগিয়ে চলার ইত্যাদি দৃশ্য চোখে মোহ জাগায়। আরও গভীরে ঢুকে দেখেন কেবল ধান ক্ষেতই নয়, দুপাশে ঘন বাগানের সারি, কত পদের ফলমূল সেখানে, মনে পড়ে যায় তার নিজ দেশের পাশে নীল নদের কথা, নীল নদের ধারে সবুজ শষ্য ক্ষেতের কথা। অত বড় নীল নদ তবুও এ এলাকা সে রূপ ছাড়িয়ে গেছে। এখানে সবুজের বন্যা বইছে যেন। 

দুই.
নেতা যেখানে বাংলা নামের এই এলাকার রূপে মজেছেন সহযোগী নাবিক তুরাজি সাথে সাথে ক্রীতদাসি কঙ্কাবতীর রূপ গুনেও মজেছে। নিজ দেশের নারীদেও ফর্সা মুখ, ফর্সা হাত পা বুক তাদের, কিন্তু এই বাঙালী শ্যামলা দাসী তার রাতের ঘুম হারাম করেছে। নেতার অগোচরে সে আড়ালে আবডালে কেবল তাকিয়ে থাকে। কি অপূর্ব তার হাতের রান্না। যেমন ফসলের উন্নত ক্ষেত তেমনি সে ক্ষেতের দাসী রাধূনী। তাকে ছুঁতে মন চায়। নেতার ভয়ে সাহস হয় না। নেতা দিল্লীতে সুলতানের দরবারে চাকুরী করেছে। নেতাকে দিল্লীর সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলঘ চীনের দূত করে পাঠিয়েছে। বাংলা ভ্রমন শেষ হলেই নেতা চীনের পথে রওয়ানা হবে। তার সঙ্গী তাকে হতেই হবে। নেতাকে তো মানতেই হবে। কিন্তু চোখ যে মানে না। কঙ্কাবতী টানে। পানি চাওয়ার বাহানায় টুকটাক ইশার কথা হয়ে যায়। এমনি করে দু একটা ভাষাও বিনিময় হয়, শেখা হয় একে অপরের ভাষা। বিনিময় হয় মিষ্টি হাসি। কঙ্কাবতী ভয় পায়, হাজার হোক সে সামান্য কৃতদাসী। দাম মাত্র এক সোনার দিনার। 

এদিকে অভিযাত্রী দলের নেতা কামারু পৌঁছে তীরে নৌকা রেখে হাঁটা পথে যাত্রা করে সেই কামেল পুরুষের সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়ে যান। সেখানে তিনি তিন দিন অতিথেয়তা গ্রহণ করেন। কামেল সুফী দরবশে হযরত শাহজালালও আরব দেশের একজন পরিব্রাজক কে পেয়ে খুবই আনন্দিত হন। 

তিন দিন পর সেখান থেকে অভিযাত্রী দলের নেতা আবার জাহাজে এসে উঠেন। তিনি আর দেরী করতে চান না। তিনি তার অতি কাঙ্খিত সুনারকাঁওয়া ( সোনার গাঁও) যেতে চান। আবার শুরু হয় যাত্রা। কামারুর উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসা নদী পথে এগোতে থাকেন। নীলচে সবুজ রঙ সে নদীর পানি। তুরাজিকে ডেকে বলেন, দেখ এই হলো নহর আল আযরাক ( নীল নদী, প্রকৃত পক্ষে সুরমা) । এ নদী পথে এগিয়ে চলার সময় দু পাশে ছোট ছোট সুন্দর সুন্দর অসংখ্য টিলা অভিযাত্রী দলের চোখে প্রচন্ড এক ভালো লাগা জাগায়। নেতার বেশি করে মনে পড়ে যায় তার স্বদেশের নীল নদের কথা। এ নদীর দুধারে আরও সামনে এগিয়ে তিনি দেখতে পান প্রচুর বাগান, মাঝে মাঝে পানি তোলার চাকা। তিনি অবাক। হন। তুরাজিকে ডেকে বলেন, দেখেছো কি আশ্চর্য এ দেশ, নদীর ভাটি পথে দশ দিন ধরে আমরা এগিরেয় চলেছি বিভিন্ন ফলমূলের বাগান, বিভিন্ন গ্রাম এর মধ্যে দিয়ে, মনে হচ্ছে যেন আমরা মূলত কোন বাজারের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছি, মনে হচ্ছে মিশরের নীল নদের তীরের শস্য সমারোহের মত এ প্রাচুর্য। তুরাজিও সুর মেলায়, আসলেই কি বিচীত্র সুন্দর আর প্রাচুর্য ভরা এ দেশ। যেন মুঠো মুঠো প্রাচুর্যের ভেতর মোহনীয় রহস্য আর নৈঃস্বর্গীক সৌন্দর্য্য।




সামনে তারা হাবাঙ্গ নগরীতে নামেন। সেখানে প্রায় একদিন তারা বিশ্রাম আর প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য কেনার জন্য অপেক্ষা করেন। দুপুরের দিকে নেতা জাহাজে ঘুমাচ্ছিলেন। কঙ্কাবতীর হাতেও কোন কাজ ছিল না। এই সুযোগ। জাহাজ থেকে নেমে একটু এগোলেই ছোট ছোট সবুজ টিলা। কঙ্কাবতী প্রথমে রাজী না হলেও, কিন্তু এক আকর্ষনে সত্যি চলে গেলো। সে এই বাংলায় জন্মালেও এমন সুন্দর ছোট ছোঠ টিলা কখনও দেখেনি। সে জন্মেছে যেখানে সে এলাকা বেশ সমতল। সেটা আরও দক্ষিণে সুন্দরবনের কাছের এলাকা। এখন আর খুব একটা মনে পড়ে না। এখন তো সে আর মানুষ নয়, কেবল এক দাসী, মূল্য মাত্র এক স্বর্ণ মুদ্রা। তুরাজিকে প্রথমে খুব খারাপ মনে হলেও এখন আর খারাপ মনে হচ্ছে না। লোকটা এখনও পর্যন্ত তার সাথে শোয়ার সুযোগ খোঁজেনি। তাছাড়া লোকটার মধ্যে কেমন এক মায়া। তুরাজি বুদ্ধিমান। নেতা জাগার আগেই তাার টিলা ঘুরে আবার জাহাজে ফিরে এল। যদিও আরাজ নামের এক আরবীয় কৃতদাসের চোখে সে দৃশ্য এড়ালো না। সে সুযোগে ফাঁস করার মানস নিয়ে চেপে গেলো ঠিকই। 

পরদিনই জাহাজ আবার এগিয়ে চলল। গন্তব্য সেই সুপ্রসিদ্ধ সুনারকাঁওয়া শহর। এর মধ্যে মূষলধারে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় জাহাজের ভেতর চুপচাপ বসেই থাকতে হলো প্রায় দুদিন। এমন আবওহাওয়ার সাথে তারা পরিচিত নয়। কেবল কঙ্কাবতী মেয়েটা দেখা গেলো সকল বিকালে সেই বৃষ্টিতে ভিজছে। নেতা অবকা হলো তার এই কান্ডে । নেতা তুরাজিকে ডেকে বললেন, আমি শুনেছিলাম অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে এই অপরূপ সুন্দও ভূমির সৌন্দর্য্য ভিনদেশিরা খুব একটা উপভোগ করতে পারে না। ভিনদেশি পর্যটক আর সেনারা স্বাচ্ছন্দ বোধ করে না এমন হঠাৎ বৃষ্টি হঠাৎ রোদেও বিরূপ আবহাওয়ায়।


তিন.
সুনারকাঁওয়া ( সোনারগাঁও) এর শাসক হলেন ফকরুদ্দিন মোবারক শাহ। তিনি নিজেকে বাংলার স্বাধীন সুলতান ঘোষনা করেছেন। নিজের নামে মুদ্রা অঙ্কন করিয়েছেন। মুদ্রাতে লেখেন-আবুল মুজাহিদ ফকরুদ্দিন মোবারক শাহ। দিল্লীর সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলঘের বিস্বস্ত এবং লাখনউটির শাসক বাহরাম খানের সামান্য একজন শিলহদার হয়েও বারহরাম খানের মৃত্যুর পর সে সোনারগাঁও দখল করে বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে নিজেক ঘোষনা করেছে। শুধু তাই না কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং চাটগাকেও নিজের অধীন করেছে। লাখনউটির পরবর্তী শাসক কূলের সাথে তার নিয়মিত বিগ্রহ লেগেই থাকে। মোবরার শাহের রয়েছে বিশাল নৌ বাহিনী। বর্ষার দিনে তাই যুদ্ধে তার জয়জয়কার। অন্যদিকে শুকনোর সময় লাখনউটির শাসকের পদাতিক বাহিনীর জয়জয়কার। এভাবেই যুদ্ধ বিগ্রহ চলছিল এই বাংলায় এলাকার দখলদারীত্বে। ওদিকে আবার দিল্লীর সুলতানও ফকরুদ্দীন মোবারক শাহের উপর নাখোস। তার অনুগত নয় সে। 

এমন এক অবস্থায় দিন রাত পনেরদিন যাত্রা শেষে তবে সোনারগাঁয়ে পৌঁছালো অভিযাত্রী দলের জাহাজ। ফকরুদ্দীন মোবারক শাহের অনেক গুনকীর্তন কানে এসেছে কযেকদিনের যাত্রা পথে। নদী পথে আসা যাওযা করতে সুলতানকে দরবেশ সুফীদের কোন খাজনা দিতে হয়না। বরং উল্টো তাদের জন্য খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্তা করা হয়। তাছাড়া কোন দরবেশ শহরে ঢুকলে তাকে স্বর্ণ মুদ্রাও দেয়া হয়ে থাকে। এমন সুলতানের দরবারে যাবার খুবই সাধ অভিযাত্রা দলের নেতার। 

প্রচুর মানুষ সে অঞ্চলের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন ভিনদেশি এই পর্যটককে। তিনিও মুগ্ধ হলেন। সোনারগাঁয়ের চারদিকে নদীঘেরা সমতল জনপদ তাকে বিমোহিত করলো। তিনি সেখানে জাহাজ ভিড়ালেন। নিজে বিশ্রাম নিতে গেলেন এবং তুরাজিকে খোঁজ খবর করতে বললেন। 

খোঁজ খবর নিয়ে তুরাজি তাকে জানাল, সুলতান নানান যুদ্ধ বিগ্রহ নিয়ে ব্যস্ত আছেন। এই জাহাজ ভেড়া নিয়েও দরবারে নানান কানা ঘুষা চলছে। সে জানাল, তাদেরকে ভিনদেশি গুপ্তচর হিসেবেও ধারণা করছে অনেকে। 

নেতা আও কিছু খোঁজ খবর করালেন। এবং বাস্তবার সুর পেয়ে কিছূটা ভীত হলেন। তিনি বুঝলেন ফকরুদ্দীন মোবরাক শাহ দিল্লী সুলতানের বিরাগভাজন ব্যক্তি। আর সে নিজে দিল্লীর সুলতানের এক চীনা দূত হতে যাচ্ছে। এ কথা ফকরুদ্দীনের কানে গেলে আসলেই সমুহ বিপদ হলেও হতে পারে। এখানে আর থাকা যাবে না। এই সুনাকাঁওয়ার রূপ তো দেখা হলোই, প্রাণে সঞ্চার করা হলো। চিরদিন এ মনে রবে। তুরাজিকে ডেকে বললেন, অপরূপ দেশ দেখলাম, কি মধুর সৌন্দর্য্য সর্বত্র, কি সস্তা আর সহজ লোভ্য বস্তু সব, কেবল অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত আর ভ্যাপসা আবহাওয়া যখন হয় আমাদের মত পর্যটকের জন্য বেশ কষ্টের হয়, রোগ শোক ধরে। আসলে এ হলো দোষখ-ই-পুরি আয্ নিয়ামত, আঞ্চলিক ভাষায় এ যেন অপার সৌন্দর্য্য আর প্রাচুর্যের এক দোযখ খানা। আমরা আজই রওয়ানা হব। খোঁজ পেয়েছি জাওয়ার (ভাভা-সুমাত্রা) যাবার জন্য একটা বড় জাহাজ সুনারকাঁওয়ার বন্দরে প্রস্তুত। ওটাতে ব্যবস্থা কর। আমরা দেরী করব না। জাওয়ার হয়েই চীনে যাব।

তুরাজি বললেন,হুজুর ঠিকই বলেছেন। এ যেন নিয়ামতের দোযখই। কিন্তু এর রুপে আমি পাগল হয়ে গেছি। বাংলার রূপ আমাকে কিনে নিয়েছে। আমি এ দেশে থেকে যেতে চাই। 

নেতা বললেন, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে। ফকরুদ্দীন সুলতান জানলে তোমরা গর্দান যাবে।

হুজুর জানবে না, আমি জমিতে নেমে যাব, গায়ে কাদা মেখে চাষবাসে লেগে যাব। আমি এদেরই একজন হয়ে যাব। তবে হুজুর আরেকটা কথা ছিল...

নেতা বললেন,বল নির্ভয়ে, আমি সুলতান টুলতান না, সামান্য পর্যটক। আমাকে কি ভয়? আর তুমি আমার অনেক বিপদেও সঙ্গী, তারোপর তুমি ফকরুদ্দীন মোবারক শাহের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে ভীষণ উপকার করেছো। যা চাওয়ার বলে ফেলো। কেবল আরেকবার ভেবে দেখ আমার সাথে যাবে কিনা?

হুজুর আপনার দাসীটি মানে কঙ্কাবতীকে আমাকে দিয়ে দেন। আমার পারিশ্রমিক কেটে রাখেন না হয়। 

কিছুক্ষণ নীরব থেকে নেতা বললেন, ঠিকাছে, তাই হবে। কেউ তোমাদের আটকানোর আগে চলে যাও, আর এই নাও তোমার পারিশ্রমিক। 

(বিঃদ্রঃ বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার বাংলাদেশ ভ্রমনের বাস্তব ইতিহাসের ঘটনাকে পুঁজি করে নানান কল্পনার আশ্রয়ে এই গল্পটি লেখা হয়েছে। এটি কেবলমাত্র একটি ইতিহাস আশ্রিত গল্প, পরিপূর্ণ ইতিহাস ভাবার অবকাশ নেই।- মামুন ম. আজিজ//২০১৪) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন